নিউজ ডেস্ক:
একের পর এক সংকট যেন পিছু ছাড়ছে না চলতি বছরের হজযাত্রায়। ভিসা জটিলতায় প্রথম দিনে হজে যেতে না পারা ১৪০ জনের সংখ্যা এখন সাড়ে ছয় হাজারের কাছাকাছি। সৌদি আরবে এজেন্সির মালিক গ্রেপ্তারের পর ৮২৩ জনের হজযাত্রা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। পরে সেটি কাটলেও নতুন করে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন ৫৩৮ হজযাত্রী।
জানা যায়, দুটি হজ এজেন্সির প্রতারণায় তাদের হজযাত্রা এখনও অনিশ্চিত। সময়মতো ৮০ শতাংশ ভিসা না করায় সৌদি আরবের লাল তালিকাভুক্তি থেকে মুক্ত হলেও নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে। বাতিল হচ্ছে একের পর এক ফ্লাইট। এখন পর্যন্ত ১৬টি ফ্লাইট বাতিল হলেও এসব হজযাত্রীর সৌদিতে পাঠানোর জন্য আরও ১০টি ফ্লাইটের স্লট চাওয়া হয়েছে। যার অনুমতি এখনও মেলেনি। ফলে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার হজযাত্রীর অনিশ্চয়তা যেন কাটছে না!
দুটি হজ এজেন্সির প্রতারণার কারণে চলতি বছর ৫৮৩ হজযাত্রীর সৌদি আরবে যাত্রা প্রায় অনিশ্চিত। এর মধ্যে রাজধানীর শ্যামপুরের এস এন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ৫৩৮ জন এবং আকবর হজ গ্রুপের ৪৫ হজযাত্রী রয়েছেন।
বিষয়টি শুনেছি। দ্রুত সমস্যার সমাধান করে হজযাত্রীদের সৌদি আরবে পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। তবে, একদম শেষ সময়ে কতটুকু সম্ভব, এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
জানা যায়, চলতি মৌসুমে এস এন ট্রাভেলস থেকে ৫৩৮ হজযাত্রীর হজ পালনে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে ৭৫ জনের ভিসা হয়েছে। ৯০ জনের টিকিট কনফার্ম হওয়ার পর গত বুধবার থেকে এজেন্সির মালিক শাহ আলম লাপাত্তা। অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মোহাম্মদপুরে তার আরেকটি অফিস ছিল। সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইল বা অন্য কোনো মাধ্যমেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা।
হজযাত্রীদের কাছ থেকে চার কোটি টাকা নিয়ে মালিকের পালিয়ে যাওয়ায় পর ভুক্তভোগীদের হজ পালন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থা ও হাবের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন ধর্ম সচিব। শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধানের পৌঁছাতে পারেননি তারা।
ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে ১৬টি ফ্লাইট
নতুন ১০টি ফ্লাইটের দিকে তাকিয়ে বিমান-হাব
এখনও ভিসা পাননি দুই হাজার ৩৭৯ জন
যাত্রী সংকটে পড়েছে বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলো
এ বিষয়ে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। দ্রুত সমস্যার সমাধান করে হজযাত্রীদের সৌদি আরবে পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। তবে, একদম শেষ সময়ে কতটুকু সম্ভব, এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’
চলতি বছরে এতসংখ্যক ফ্লাইট বাতিলের মূল কারণ হজ এজেন্সির গাফিলতিতে ভিসা জটিলতা এবং ৩০ শতাংশ হজযাত্রীকে মদিনায় পৌঁছানোর শর্ত। গত ১২ জুন পর্যন্ত মোট ১৪টি হজ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নয়টি, সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের পাঁচটি ফ্লাইট। এরপর আরও দুটি ফ্লাইট বাতিল হলেও কোন এয়ারলাইন্সের কতটি, তা জানা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে, আকবর হজ এজেন্সির প্রতারণায় ৪৫ যাত্রী গত বছর হজে যেতে পারেননি। তাদের চলতি বছর হজে পাঠানোর কথা ছিল। সে অনুযায়ী আকবর হজ গ্রুপের দুই এজেন্সি সাবিলুল জান্নাহ এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও আল-মামুন এয়ার ট্রাভেলসকে বাড়তি টাকাও দেওয়া হয়। কিন্তু আকবর হজ গ্রুপ শেষ মুহূর্তে তাদের হজে পাঠাতে পারবে না বলে জানায়। পরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
সৌদি পুলিশের হাতে মালিকরা আটক হওয়া পর থেকে ৮২৩ হজযাত্রীর যাত্রার বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আমরা শুরু থেকে সবাইকে হজে পাঠানোর বিষয়ে আত্মপ্রত্যয়ী ছিলাম এবং প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
সেখানে জানানো হয়, ২০২৩ সালে হজে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকবর হজ গ্রুপের আওতাধীন সাবিলুল জান্নাত এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও আল মামুন এয়ার ট্রাভেলস হজযাত্রীদের ট্রান্সফার করে নিয়ে আসে। সেজন্য তাদের অতিরিক্ত টাকাও দেওয়া হয়। টাকা নিয়ে তাদের মূল নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু নিবন্ধনের ১০ দিন পর জানানো হয় যে তাদের কোনো টাকা জমা হয়নি। নতুন করে টাকা দিতে হবে। তা না হলে নিবন্ধন বাতিল হবে। বিষয়টি হাব অফিস পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
নয় লাখ রিয়াল নিয়ে সৌদি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন কোবা এয়ার ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. মাহমুদুর রহমান এবং তার ছেলে ইউরো ও আহসানিয়া হজ মিশনের মালিক সাদ বিন মাহমুদ। তাদের অধীনে ৮২৩ হজযাত্রীর ১ জুন সৌদি আরবে যাওয়ার কথা। কিন্তু মালিক আটক হওয়ায় ওই তিন হজ এজেন্সির অধীনে নিবন্ধিত ৮২৩ জনের হজ পালন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। পরে হাবের মধ্যস্থতায় তাদের সৌদিতে পাঠানো হয়েছে। ২, ৪ ও ১৩ জুন তিনটি ফ্লাইটে ৬৮৫ জন এবং সর্বশেষ ১৪ জুন বাকি ১৩৮ জনকে সৌদিতে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে হাব সভাপতি বলেন, সৌদি পুলিশের হাতে মালিকরা আটক হওয়া পর থেকে ৮২৩ হজযাত্রীর যাত্রার বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আমরা শুরু থেকে সবাইকে হজে পাঠানোর বিষয়ে আত্মপ্রত্যয়ী ছিলাম এবং প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়, মক্কা হজ মিশন ও সৌদি সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
হজযাত্রী সংকটের কারণে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৬টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। বাতিলের কারণে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার হজযাত্রী এখন তাকিয়ে আছেন নতুন ফ্লাইট স্লট পাওয়ার ওপর। ইতোমধ্যে ক্যাপাসিটি লস পূরণে আরও ১০টি অতিরিক্ত ফ্লাইটের স্লট চেয়ে সৌদি সিভিল এভিয়েশনের (জিএসিএ) কাছে আবেদন করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। যদিও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ স্লট পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম।
তিনি জানান, ক্যাপাসিটি লস পূরণে ১০টি নতুন ফ্লাইটের অনুমতি চেয়েছি। আশা করি পেয়ে যাব।
এদিকে, সৌদির হজ ও ওমরাবিষয়ক উপমন্ত্রী আব্দুল ফাত্তাহ সুলাইমান মাশাতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ১০টি ফ্লাইট চালানোর অনুমতি চেয়েছেন সৌদিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
হাব নেতারা জানান, চলতি বছরে এতসংখ্যক ফ্লাইট বাতিলের মূল কারণ হজ এজেন্সির গাফিলতিতে ভিসা জটিলতা এবং ৩০ শতাংশ হজযাত্রীকে মদিনায় পৌঁছানোর শর্ত। গত ১২ জুন পর্যন্ত মোট ১৪টি হজ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নয়টি, সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের পাঁচটি ফ্লাইট। এরপর আরও দুটি ফ্লাইট বাতিল হলেও কোন এয়ারলাইন্সের কতটি, তা জানা সম্ভব হয়নি।
বাতিল হওয়া ফ্লাইটগুলো হলো- গত ২৬ মে দুটি, ২৮ ও ২৯ মে একটি করে, ৩১ মে দুটি, ৩ জুন দুটি, ৬ জুন দুটি, ৮ জুন একটি, ৯ জুন একটি এবং ১১ জুন দুটি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। আরও কয়েকটি ফ্লাইট বাতিল হতে পারে বলে ১২ জুন জানিয়েছিল বিমান কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে হাবের সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, হজ ফ্লাইট বাতিল হওয়ার মূল কারণ হলো মদিনায় ৩০ শতাংশ হজযাত্রী পৌঁছানোর নতুন শর্ত। এটা না জেনে মন্ত্রণালয় করেছে, ফলে এর খেসারত দিতে হচ্ছে বিমান ও এজেন্সিগুলোকে।
‘মদিনায় কমপক্ষে আট দিন অবস্থান করতে হবে- এমন শর্ত রয়েছে। এজন্য আট দিন পরপর মদিনা ফ্লাইট দিতে হচ্ছে। ফলে মদিনাগামী ফ্লাইট বেশি বাতিল হচ্ছে।’
ঢাকার আশকোনা হজ অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জুন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সৌদি আরবের সৌদিয়া ও ফ্লাইনাস ২৩৭টি ফ্লাইটে ৮৯ হাজার ১৫৪ হজযাত্রীকে নিয়ে সৌদিতে পৌঁছেছে।
যাত্রী সংকটের কারণে একের পর এক ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে তিনটি এয়ারলাইন্স। সেই ক্ষতি পোষাতে এবার নিয়ম ভেঙে বাণিজ্যিক ফ্লাইটে হজযাত্রী বহন করেছে সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স (সাউদিয়া)। হজযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত ফ্লাইট পরিচালনার নির্দেশনা ছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের। তবে, সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে হজযাত্রীও বহন করেছে তারা।
গত ১৩ জুন এসভি-৮০৫ ফ্লাইটে সাধারণ যাত্রীর সঙ্গে হজযাত্রীদের রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর রিয়াদ থেকে তাদের ডমেস্টিক ফ্লাইটে জেদ্দা পৌঁছে দেওয়া হয়। বাণিজ্যিক ওই ফ্লাইটে প্রায় ৭০ জন হজযাত্রী ছিলেন। এ বিষয়ে সৌদি এয়ারলাইন্স জানায়, তারা ধর্ম মন্ত্রণালয়কে জানিয়েই এটি করেছে। ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইটে তাদের কিছু ক্যাপাসিটি লস হয়েছে। সেটা অ্যাডজাস্ট করতেই কমার্শিয়াল ফ্লাইটে হজযাত্রী নেওয়া হচ্ছে।
আসছে মঙ্গলবার (২২ জুন) শেষ হচ্ছে চলতি বছরের হজ ফ্লাইট। এরপর শুরু হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা। তবে, এখনও ভিসা পাননি দুই হাজার ৩৭৯ জন। চলতি বছর সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের হজে যাওয়ার কথা। কিন্তু খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় নয় দফা সময় বাড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত কোটা পূরণ করা যায়নি। সর্বশেষ এক লাখ ২২ হাজার ৫৫৮ হজযাত্রী সৌদি আরবে যাবেন। এর মধ্যে শুক্রবার (১৬ জুন) পর্যন্ত ভিসা পেয়েছেন এক লাখ ২০ হাজার ১৭৯ জন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় শতভাগ ভিসা পেলেও বেসরকারিতে বাকি রয়েছে দুই হাজার ৩৭৯ জন।
হজ-সংশ্লিষ্টরা জানান, সৌদি ভিসা করানোর জন্য মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া, মোয়াল্লেমসহ দেশটির দেওয়া বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে হজযাত্রীদের ভিসা করতে হয়। কিন্তু হজ এজেন্সিগুলো শেষ সময়ে কম দামে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে ভাড়া করতে পারে না। ফলে হজযাত্রীরা ভিসার আবেদনও করতে পারেন না।
ফ্লাইট সূচি অনুযায়ী, আগামী ২২ জুন সৌদি আরবে হজযাত্রার শেষ ফ্লাইট যাবে। তাদের ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে ২ জুলাই এবং শেষ ফিরতি ফ্লাইট ২ আগস্ট।
চলতি বছর প্রি-হজ ফ্লাইটে মোট ১৬০টি ডেডিকেটেড ফ্লাইট পরিচালনা করবে বাংলাদেশ বিমান। এর মধ্যে ঢাকা-জেদ্দা রুটে ১১৬টি, ঢাকা-মদিনা রুটে ২০টি, চট্টগ্রাম-জেদ্দা রুটে ১৪টি, চট্টগ্রাম-মদিনা রুটে ছয়টি, সিলেট-জেদ্দা ও সিলেট-মদিনা রুটে দুটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন বা ২৮ জুন পবিত্র হজ পালিত হবে। বাংলাদেশ থেকে এবার এক লাখ ২২ হাজার ২২১ জন হজ পালনে যাচ্ছেন।
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৩ দৈনিক আজকের খবর
Leave a Reply