অনলাইন ডেস্ক:রাজশাহীতে পাড়া-মহল্লার বখাটে ও মস্তানদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন নির্মাণাধীন ভবনের মালিকরা। চাঁদাবাজির পাশাপাশি তারা জোর করে ভবনের বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নিয়ে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করছে। এর প্রতিবাদ করলে বিপদে পড়তে হচ্ছে মালিকদের। আবার চাঁদার দাবিকৃত টাকা বা ভবনের কাজ না দিলে নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন মালামাল চুরি করেও নিয়ে যাচ্ছে তারা। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের কিছু স্থানীয় নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মদদ থাকায় এ নিয়ে নালিশ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। পুলিশ বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে; তবে অভিযোগ দিতে সাহস পাচ্ছেন না মালিকরা। এই পরিস্থিতির মধ্যে ঈদকে সামনে রেখে পাড়া-মহল্লার চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে চাঁদা না দেওয়ায় এক ভবন মালিককে কুপিয়ে জখমের ঘটনাও ঘটেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সম্প্রতি রাজশাহী নগরীতে বহুতল ভবন নির্মাণ বেড়েছে। বেশির ভাগ ভবন পেশাদার ডেভেলপাররা নির্মাণ করছেন। তবে কিছু কিছু ভবন জমির মালিকেরা নিজেই করছেন। আবার শেয়ারিংয়ের মাধ্যমেও গড়ে উঠছে অনেক বহুতল ভবন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজেদের কষ্টার্জিত ও সঞ্চয়ের অর্থ দিয়ে এসব ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কারণে পদে পদে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন ভবন নির্মাতারা। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের নামে পাড়ার বখাটে-মস্তানদের চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। আর যারা নিজেরা ভবন করছেন, তাদের বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিতে হচ্ছে পাড়ার বখাটে-মস্তানদের। এতে বিড়ম্বনা আরও বাড়ছে।
কয়েকজন ভবন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কাছ থেকে উচ্চ দরে ইট, খোয়া, সিমেন্ট থেকে শুরু করে টাইলস, স্যানিটারি ও ওয়্যাারিং সামগ্রী কিনতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। যারা কাজ পাচ্ছে, তাদেরই লোকজন কৌশলে বিভিন্ন মালামাল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কাজ না দিলেও চুরি করানো হচ্ছে। চাপে পড়ে কেউ চুরির কথা স্বীকার করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা বখাটে-মস্তানদের পক্ষে থাকার কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এসব সিন্ডিকেটের পেছনে এলাকাভিত্তিক ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরও শক্তিশালী হাত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ডাবতলার অদূরে বসুয়া এলাকায় একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ হচ্ছে। ‘বসুয়া টাওয়ার’ নামের এ ভবনটি শেয়ারিংয়ের ভিত্তিতে ১৮ জন বিভিন্ন পেশার মানুষ নির্মাণ করছেন। সম্প্রতি ওই ভবনের ওয়্যারিং তারের ১২টি কয়েল চুরির ঘটনা ঘটে। নির্মাণাধীন ভবনের মালিকরা এতে হতাশ হয়ে পড়েন। ওই ভবনে ওয়্যারিং ও স্যানিটেশন কাজের দায়িত্বে ছিলেন আরিফ নামের এক ব্যক্তি। প্রথমে তিনি এই বৈদ্যুতিক তার চুরির বিষয়টি অস্বীকার করছিলেন। পরে ভবন মালিকদের নানা জেরার মুখে এক পর্যায়ে চুরির কথা স্বীকার করেন। এর পরও সিন্ডিকেটের হাত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। আপসের নামে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখেন।
নগরীর কুমারপাড়া এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন শওকত আলী। ভবনটির নির্মাণকাজে থাকা রড চুরি হচ্ছে প্রায়ই। সম্প্রতি একজনকে হাতেনাতে ধরেন পাহারাদাররা। শওকত আলী জানান, চুরি সিন্ডিকেটের কাছে ভবন মালিকরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। নগরীর কয়েকজন আবাসন ব্যবসায়ী জানান, তাদের নির্মাণাধীন ভবনেও প্রতিনিয়ত মালামাল চুরির ঘটনা ঘটছে।
এদিকে রাজশাহী মহানগরীতে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে হাফিজুল হক নামে এক ডেভেলপারকে কুপিয়ে জখম করেছে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা। বুধবার দুপুরে নগরীর বোয়ালিয়া থানার রানীনগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় সন্ত্রাসীরা নির্মাণসামগ্রী ভাঙচুর ও লুট করে নিয়ে যায়। এ নিয়ে মামলা হলেও কোনো সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়নি। তবে বোয়ালিয়া থানার ওসি হুমায়ুন কবীর বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
হাফিজুল অভিযোগ করেন, তিনি রানীনগর এলাকায় একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করছেন। গত কয়েক দিন ধরে এলাকায় চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত আলিফের নেতৃত্বে ইউসুফ, অনন্ত, মিমসহ পাঁচ-ছয়জন সন্ত্রাসী নির্মাণস্থলে গিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। চাঁদা না পেয়ে তারা শ্রমিকদের মারধর শুরু করে চলে যায়। পরে বুধবার দুপুরের দিকে আলিফের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা আবার নির্মাণস্থলে গিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাফিজুলকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এলাকাবাসী হাফিজুলকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
রাজশাহীর একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন ঈদ বা পহেলা বৈশাখের মতো কোনো উৎসব এলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। দলবেঁধে নানা সংগঠনের নামে চাঁদা তুলতে আসে। এবার মহান বিজয় দিবসে ৩২টা দলকে অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কতটা বিপদে আছি, এবার বোঝেন।’
রাজশাহীর আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশনের (রেডা) সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান কাজী বলেন, ‘আমরা অনেক সময় ভালো প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে খুশিমনেই স্পন্সর করে থাকি। কিন্তু কখনো কখনো বাধ্যও হই। এটা আমাদের জন্য চাপ হয়ে যায়। রাজশাহীতে এ পরিস্থিতি আগে ছিল না। ইদানীং শুরু হয়েছে। কয়েক দিন আগে সংরক্ষিত নারী আসনের এক কাউন্সিলর এসে জানালেন, তার এলাকায় এক ব্যক্তি নিজেই বাড়ি করছেন। তাকে ৪ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। আরও টাকার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টির সমাধানের পথ খুঁজতে ওই নারী কাউন্সিলর পরামর্শ নিতে এসেছিলেন।
জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জামিরুল ইসলাম জানান, থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। ভবন মালিকরা চুরির অভিযোগ না করলে পুলিশের কিছু করার থাকে না। চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: আমাদের সময়
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৩ দৈনিক আজকের খবর
Leave a Reply