আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়া পৃথিবী অচিরেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ রেকর্ড স্পর্শ করতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন জলবায়ু গবেষকরা। তারা বলছেন, সক্রিয় হচ্ছে এল নিনো। জলবায়ুর উষ্ণতার প্রভাবে দ্রুত গলছে বরফ। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি বড় জলাধার শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার ৬৬ শতাংশ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করলে তা হবে অত্যন্ত উদ্বেগের।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত শিল্পায়নের ফলে কার্বন নির্গমনের হার বেড়ে গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব উত্তপ্ত হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, ২০১৬ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ছিল ১.২৮ সেলসিয়াস, যা শিল্পায়নের আগে বিশ্বের তাপমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি।
২০২২-২০২৬ সালের মধ্যে অন্তত একটি বছর বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের বার্ষিক তাপমাত্রা শিল্পায়ন যুগের আগের সময়ের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হবে তুলে ধরে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবী কমপক্ষে একটি বছর সবচেয়ে উষ্ণ সময় দেখবে, যা ২০১৬ সালের রেকর্ড ভেঙে দেবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে গবেষকরা ৯৮% নিশ্চিত হয়েছেন যে, ২০২৭ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা অতীতের ওই সীমা অতিক্রম করবে। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, সম্ভবত এটা অস্থায়ী হবে। সে ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যাবে।
সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল প্রফেসর পেট্টেরি তালাসের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আবহাওয়ায় এল নিনোর (উষ্ণ সামুদ্রিক স্রোত) প্রভাব শুরু হতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’
বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে। বরফ গলতে থাকায় বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এখনো তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
অবশ্য অনেক বিজ্ঞানী আশঙ্কা করেছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট ভয়ঙ্কর পরিণতি ঠেকানোর কোনো উপায় থাকবে না। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব বিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম হবে। ব্রিটেনে বৃষ্টিপাতের মাত্রা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়ে ঘনঘন বন্যা হবে। সাগরের উচ্চতা বেড়ে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ছোট অনেক দ্বীপ বা দ্বীপরাষ্ট্র বিলীন হয়ে যেতে পারে। আফ্রিকার অনেক দেশে খরার প্রকোপ বাড়তে পারে এবং পরিণতিতে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। অস্ট্রেলিয়ায় অতিরিক্ত গরম পড়তে পারে এবং খরার প্রকোপ দেখা দিতে পারে।
বিশ্ব উত্তপ্ত হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ গ্রিনহাউজ গ্যাস। করোনা মহামারি চলার সময় এটি কমলেও এখন আবার বাড়ছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এল নিনোর সম্ভাব্য উপস্থিতি। আবহাওয়ায় এল নিনো সক্রিয় থাকলে মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উষ্ণতা বাড়ে।
গত তিন বছর ধরে বিশ্ব একটি লা নিনার মুখোমুখি হচ্ছে যা জলবায়ু উষ্ণায়নকে কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বে যে অতিরিক্ত তাপ তৈরি হবে তার প্রভাবে আগামী বছর উষ্ণতা বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এ বিষয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিসের দীর্ঘকালীন আবহাওয়া পূর্বাভাসের প্রধান অ্যাডাম স্কেইফের উদ্ধৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইতিহাসে এবারই প্রথমবারের মতো আমরা উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির এত কাছাকাছি রয়েছি।’
অ্যাডাম স্কেইফ আরও বলেছেন, ‘এল নিনোর প্রভাব নিয়ে আমাদের যে পূর্বাভাস, তা শীতকালে দেখা যাবে। কিন্তু পাঁচ বছরের সময়ের মধ্যে যা ঘটবে তার সঠিক দিন তারিখ আমরা এখনই দিতে পারবো না, এখন থেকে তিন বা চার বছরের মধ্যে এমনটা হতে পারে- এল নিনোর প্রভাবে এমনটা ঘটতে পারে।’
বিজ্ঞানীদের মতে ‘এল নিনো’ হচ্ছে পর্যায়বৃত্তের উষ্ণ পর্যায়, আর ‘লা নিনা’ হচ্ছে শীতল পর্যায়। ‘না নিনা’ পৃথিবীতে শীতলতম অবস্থা বজায় থাকতে ভূমিকা রাখে।
সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরাও স্যাটেলাইটের ছবি পর্যবেক্ষণ করে প্রশান্ত মহাসাগরের এল নিনো দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দিক দিয়ে এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন। এর জন্য সাগরে ঢেউয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বলছেন, নিরক্ষরেখায় ঢেউয়ের উৎপত্তি হওয়ায় পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটা।
বিজ্ঞানী জোস উইলস ১৭ মে সংবাদমাধ্যম এপিবিকে জানান, ‘এল নিনোর জেরে ভারতসহ গোটা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন হবে।’
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানায়, আগামী জুলাই মাসে এল নিনোর আসার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরের শেষে তা ৮০ শতাংশ। এল নিনোর প্রভাবে ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া বরাবর ভূপৃষ্ঠে চাপ বেড়ে যায়। পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের বায়ুচাপ কমে যায়। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বাণিজ্য-বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে বা পূর্বদিকে বইতে শুরু করে। পেরুর সন্নিকটে গরম বাতাস ঘনীভূত হওয়ার কারণে পেরুর উত্তরের মরু-অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে গরম পানি ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে। সঙ্গে করে নিয়ে যায় প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প অর্থাৎ বৃষ্টি। ফলে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল খরায় পুড়তে থাকে, আর পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে প্রচুর বৃষ্টি হয়।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা জানান, এল নিনো বছরগুলোতে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৯৭ সালে এমনটি ঘটেছে। এ বছরও দেশে বৃষ্টিপাত যতটা হওয়া দরকার ততটা হয়নি। কিছুটা খরাজাতীয় অবস্থা বিরাজ করছে। এল নিনোর জন্য মৌসুমি বায়ু পূর্বদিক থেকে পশ্চিমে যতটা বেগে আসার কথা ছিল, ততটা হয়নি। দুর্বল মৌসুমি বায়ুর কারণে বৃষ্টিপাতও কম হয়েছে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি ভালোভাবে বুঝা যাবে। তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে তা এক বা দুই দশক চললে এর মারাত্মক প্রভাব দেখা যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ থাকায় মারাত্মক ঝড় ও তীব্র দাবানল দেখা যাবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি বড় হ্রদ ও জলাধার শুকিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে পানির ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ তীব্রতর করছে।
সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি বড় হ্রদ ও জলাধার শুকিয়ে সংকোচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল জানিয়েছে, ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যবর্তী ক্যাস্পিয়ান সাগর থেকে দক্ষিণ আমেরিকার লেক টিটিকাকা পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিঠা পানির উৎসগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রায় তিন দশক ধরে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে প্রায় ২২ গিগাটন পানি হারিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম জলাধার লেক মিয়াদের আয়তনের প্রায় ১৭ গুণ।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, প্রাকৃতিক হ্রদের শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে ৫৬ শতাংশ জলবায়ুর উষ্ণায়ন এবং মানুষের ব্যবহারের কারণে হয়েছে। তবে এই দুটির মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বড় ভূমিকা পালন করেছে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সাধারণত মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের শুষ্ক অঞ্চলগুলো আরও শুষ্ক হয়ে এবং আর্দ্র অঞ্চলগুলো আরও আর্দ্র হয়ে উঠবে। তবে গবেষণায় আর্দ্র অঞ্চলেও পানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে দেখা গেছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার সারফেস হাইড্রোলজিস্ট ফ্যাংফ্যাং ইয়াও সায়েন্স জার্নালে এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে বিশ্বের দুই হাজার জলাশয় এবং হ্রদ পর্যবেক্ষণ করে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন গবেষকরা। এতে শুকিয়ে যাওয়া হ্রদ অববাহিকায় বসবাস করা প্রায় ২০০ কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক অঞ্চলে বহু মানুষ পানির সংকটের মুখেও পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি থেকে রেহাই পেতে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি বলে মনে করছেন।